খালেদা খাতুন
“Your Diet is a bank account. Good food choices are good investments”- Bethenny Frank
জ্যৈষ্ঠর তীব্র গরম ও কোভিড-১৯ আতঙ্কের মধ্য দিয়ে শুরু হলো মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস, পবিত্র রমজান। এই বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি বিশ^জুড়ে বিরাজমান করোনা মহামারী থেকে বাঁচতে পৃথিবীময় চলছে যুদ্ধ, তবু মিলছে না মুক্তি। ইতোমধ্যে বিশ^ব্যাপী এ ভাইরাস প্রাণহানি ঘটিয়েছে প্রায় পৌনে ৩ লক্ষ মানুষের। করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দেশব্যাপী চলছে সাধারণ ছুটি।
রোগ, রোগের ধরণ, বিস্তার ও পরিণতি
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস জীবনযাপন মানুষকে অসুস্থতা অর্থাৎ রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। রোগ হচ্ছে মানুষের এক ধরনের অসুস্থতা যা তার শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় মানবদেহ তার প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সঠিকভাবে সম্পাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মানুষ সাধারণত দু’ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়- ১. সংক্রামক রোগ ২. অসংক্রামক রোগ
সংক্রামক রোগগুলো খুব সহজেই অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে ও শরীর হতে সংস্পর্শ হাঁচি, কাশি, থুতু বা কীটপতঙ্গের মাধ্যমে অন্য মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। এগুলো জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায় এবং জীবাণু বাতাস, খাবার, পানি বা সংস্পর্শের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
অন্যদিকে অসংক্রামক রোগগুলো সংস্পর্শে বা অন্যকোনো মাধ্যমে ছড়ায় না। এই রোগগুলো সাধারণত: মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি, জন্মগত শারীরিক অবস্থা, জিনগত বৈশিষ্ট্য বা তার চারপাশের পরিবেশ দূষণ অবস্থার কারণে সৃষ্ট রোগ। এগুলো হচ্ছে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, সারাবিশে^ সকল মৃত্যুহারের মধ্যে প্রতি বছর অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে-৭০%। এর মধ্যে সিভিডি-১৯.৯ মিলিয়ন, সিভিডি ক্যান্সার-৯.০ মিলিয়ন ফুসফুসীয় রোগে ৩.৯ মিলিয়ন, ডায়াবেটিসে ১.৬ মিলিয়ন প্রতি বছর লোক মারা যাচ্ছে।
অন্যদিকে ২০ মিলিয়ন মারা যাচ্ছে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। এর মধ্যে ১৬ মিলিয়ন অর্থাৎ ৮০% ইনফেকশাস বা প্যারাসাইটিক রোগে মারা যাচ্ছে। এদের মধ্যে য²া-৩ মিলিয়ন, ম্যালেরিয়া-২ মিলিয়ন, হেপাটাইটিস-বি-সম্ভবত ১ মিলিয়ন প্রতি বছর মারা যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণীকে বোঝায় যা মানুষের মধ্যে শ^াসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। করোনাভাইরাস রাইবোভিবিয়া পর্বের নিদুভাইরাসবর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপগোত্রের সদস্য।
মুকুটসদৃশ এ সংক্রামক ভাইরাসটি পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ ভাইরাস যার উপরিভাগে প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যুকে নষ্ট করে। ভাইরাসটি কোনো জীবন্ত সত্তা নয় বরং এটি প্রোটিন অনু (ডিএনএ), লিপিড এর প্রতিরক্ষা আবরণী দ্বারা আবৃত যা জেনেটিক কোড পরিবর্তন করে। এর পাতলা চর্বির স্তর দ্বারা আবৃত বহিঃআবরণ থাকে। এ কারণে সাবান বা ডিটারজেন্ট এক্ষেত্রে উত্তম প্রতিরোধ কেননা সাবানের ফেনা চর্বি কাটাতে সাহায্য করে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকদের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্তও থাকতে পারে। আবহাওয়া, আর্দ্রতা ও বস্তুর উপর এটি অবস্থান করে এ বিষয়গুলোর উপর ভাইরাসটির পতনকাল নির্ভর করে। দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী এ ভাইরাসটি নিজে নিজেই ধ্বংস হয়।
করোনা প্রতিরোধে প্রথম শর্ত হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা। ইমিউনিটি ঠিক রাখার জন্য চাহিদা অনুযায়ী যার যতটুকু খাবার প্রয়োজন তা গ্রহণ করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খাবারটি ব্যালান্সড ডায়েট হয়।
উল্লেখ্য, পিএইচ ৫.৫-৮.৫ এর মধ্যে এ ভাইরাসটির বিস্তৃতি। তাই যেসব খাদ্যে পিএইচ এর পরিমাণ ৮.৫ এর বেশি সেসব খাদ্য গ্রহণ আবশ্যক। এখানে কিছু ফল ও তাদের পিএইচ মাত্রা দেয়া হলো।
ফলের নাম পিএইচ মাত্রা
লেবু ৯.৯
বাতাবি লেবু ৮.২
আভাকাডো ১৫.৬
রসুন ১৩.২
আনারস ১২.৭
কমলা ৯.২
ঞধহমবৎরহব ৮.৫
উধহফবষরড়হ ২২.৭
করোনাভাইরাস যেভাবে ছড়ায়
- মূলত বাতাসের এয়ার ড্রপলেট এর মাধ্যমে
- হাঁচি ও কাশির ফলে
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে
- ভাইরাস আছে এমন কোনো কিছু স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে মুখে, নাকে ও চোখে লাগালে।
- পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
লক্ষণ
- সর্দি, কাশি, জ¦র, মাথাব্যথা, গলাব্যথা
- মারাত্মক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
কিছুক্ষণ পর পর সাবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া। এক্ষেত্রে গরম পানি ব্যবহার অধিক শ্রেয়। কারণ, করোনাভাইরাসের বহিঃআবরণে যে পাতলা চর্বি স্তর রয়েছে তা তাপে গলে যায়। তাই সাবান বা ডিটারজেন্ট এক্ষেত্রে উত্তম প্রতিরোধক হলেও সাথে গরম পানির ব্যবহার ভাইরাস নিধনের গতিকে ত্বরান্বিত করে। তাই হাত ধোয়া, কাপড় ধোয়া ও অন্যান্য কাজের জন্য গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
- প্রচুর ফলের রস ও গরম পানি পান করা
- হাত না ধুয়ে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ না করা
- হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা
- মুখে মাস্ক ব্যবহার করা
- ঠাÐা বা ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে না মেশা
- বন্য জন্তু কিংবা গৃহপালিত পশুকে খালি হাতে স্পর্শ না করা
- মাংস, ডিম খুব ভালোভাবে রান্না করা
- হাঁচি কাশি দেয়ার পর, রোগীর সুশ্রƒষা করার পর, টয়লেট করার পর ও খাবার প্রস্তুত করার আগে ও পরে পরিষ্কার করে হাত ধুতে হবে।
- পরিষ্কার করলে যেকোন প্রকারের অ্যালকোহলিক মিশ্রণ (যাতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৬৫% এর উপরে) ব্যবহার করতে হবে কারণ সেটি ভাইরাসের বহিঃ স্তরকে দূরীভ‚ত করতে পারে।
সুস্থ থাকতে রমজান, গ্রীষ্মকাল, করোনা মহামারী, লকডাউন এ সবকিছুকে মাথায় রেখে আমাদের সুস্থ থাকতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা নির্বাচন করতে হবে।
করোনা প্রতিরোধে প্রথম শর্ত হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা। শরীরকে স্ট্রেস ফ্রি রাখা। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই এ সময়ে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, ভিটামিন এ, ই, সি, বিটা-ক্যারোটিন, জিংক, মেলেনিয়াম এগুলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভিটামিন ও মিনারেল। এবারের রোজায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলাও আবশ্যক যাতে সুস্থতার সাথে রোজা পালন করা যায়। জ্যৈষ্ঠের এই সময়ে প্রায় ১৫ ঘন্টা সময় রোজা রাখার পর ইফতার করতে হবে। তাই খাদ্য গ্রহণে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ
- পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পান করে দেহের পানি স্বল্পতা দূর করা; কেননা ডিহাইড্রেশন দেহের ইমিউনিটিকে দুর্র্বল করে দেয়। চোখ, নাক, মুখ, ফুসফুসের মিউকাস কমে যায়। ফলে জীবানু আক্রমণ দ্রæত হয়। মিউকাস দেহকে জীবাণু সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে।
- চাহিদা অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ। ভিটামিন ও মিনারেল যেমন - ভিটামিন-এ, সি, ই, বিটা ক্যারোটিন, জিংক ও মেলেনিয়াম ইত্যাদি।
- কড়াভাজা ও ভুনা খাবার পরিহার করা। কারণ, এগুলো শরীরে ফ্রি রেডিকেল তৈরী করে।
- প্রতিদিন ১টি ডিম খাদ্যতালিকায় রাখুন। কারণ ডিমের কুসুমে ভিটামিন এ, ডি, জিংক কোলিন, মেলেনিয়াম সমৃদ্ধ এবং ডিমের প্রোটিন উচ্চ জৈবমূল্য সমৃদ্ধ।
- তাজা রঙিন শাকসবজি ও ফল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা। এরা ওজন নিয়ন্ত্রণ ও হজমে সাহায্য করে।
- একজন ব্যক্তির বয়স, ওজন, উচ্চতা কাজের ধরন এবং বাজারে খাদ্যের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিনের খাদ্য নির্বাচন করতে হবে। সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে তাই এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে সারা বছরের খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
- দীর্ঘসময় পেট খালি থাকার কারণে বিপাক ক্রিয়ার গতি কমে যায়। সেই সাথে হুট করে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণে লিভার ও কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তাই ইফতারি হতে হবে হালকা কিন্তু উচ্চ জৈবমূল্য সমৃদ্ধ খাবার। যেমন: ছোলা-খেজুর, ডিম, ফল। ইফতার শেষ করে মাগরিবের নামায এর পর খাদ্যতালিকায় নির্ধারিত সকালের খাবারটি রাখা যেতে পারে। এরপর তারাবি নামাযের শেষে বা পূর্বে রাতের খাবার খাবে। নির্ধারিত দুপুরের খাবারটি খেতে হবে সেহরীতে। খাওয়া শেষে ১ কাপ দুধ খেতে হবে। যাদের দুধে সমস্যা তারা ১ কাপ দুধের তৈরী টকদই খেতে পারেন। সেহরিতে খুব আগে খাওয়া শেষ না করাই ভালো। সেহরিতে এমনভাবে খেতে হবে যেন সময় শেষ হবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে খাদ্য গ্রহণ শেষ হয়। এ বিষয়টি বিশেষভাবে ডায়াবেটিক রোগীদের।
- খাদ্যতালিকা হতে কার্বহাইড্রেট কোনভাবেই বাদ দেয়া যাবে না।
ফল হলো বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল, আঁশ এবং নানা রকম প্রাকৃতিক ফটোকেমিক্যাল এর উৎস। যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উৎপন্ন করে শরীরকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব। বলা হয়ে থাকে, জ্যৈষ্ঠ মাস হলো মধুমাস। তাই এ সময়ের পাকা আম, পেঁপে, কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙি এসব ফল থেকে প্রাপ্ত বিটা-ক্যারোটিন ও লাইকোপিন শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। পেয়ারা, আমড়া, করমচা, অরবরই, পায়লা, আমলকী, কমলালেবু, জাম্বুরা ইত্যাদি টকজাতীয় ফল ভিটামিন সি এর ভালো উৎস। এবং শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উৎপন্ন করে। নানারকম সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করে।
সুতরাং আসুন আমরা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণ করি এবং নিজে ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে সুস্থ জাতি গঠন করি যা আমাদের ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং কে সফল করি বা সুন্দর কর্মমুখর পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনি আর কিছুদিন ঘরে থাকি ও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার আইইডিসিআরের নির্দেশনা মেনে চলি। আর উপরের নিয়ম মেনে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলি। তবেই আমরা সুস্থ থাকবো আগামীর দিনগুলোতে। “আইন প্রয়োগ করে নয়, ব্যক্তিগত সচেতনতাই উন্নত জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার।” য়
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম, শাহবাগ, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭০৩৭৯৬২৬৯, ই-মেইল : birdem@yahoo.com